খন্দকের যুদ্ধ এবং সোনালী বিজয়

খন্দকের যুদ্ধ এবং সোনালী বিজয়


খন্দকের যুদ্ধে অনেক পরিখা খনন করা হয়, তাই এর নাম দেওয়া হয়েছে খন্দকের যুদ্ধ। এ যুদ্ধ আহজাব নামেও পরিচিত। আহজাব অর্থ সম্মিলিত বাহিনী। খন্দক শব্দের অর্থ পরিখা বা গর্ত। ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে মক্কার কুরাইশ, মদিনার ইহুদি, বেদুইন, পৌত্তলিকেরা সম্মিলিতভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করেছিল।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। 


এই যুদ্ধে শত্রুদের সৈন্যসংখ্যা ছিল ১০ হাজার, যা ছিল মদিনার মোট জনসংখ্যার চেয়ে বেশি। মুসলিম বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ছিল ৩ হাজার। কিন্তু তারা যে অভিনব যুদ্ধকৌশল অবলম্বন করে, তা শত্রুদের অজানা ছিল। ফলে তারা হতাশাগ্রস্ত ও পর্যুদস্ত হয়ে অবশেষে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। 


আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে মক্কা থেকে ১০ হাজার লোকের সম্মিলিত বাহিনী মদিনার দিকে যাত্রা করে। মক্কার সম্মিলিত বাহিনীর যুদ্ধযাত্রার খবর পেয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবিদের নিয়ে পরামর্শ করলেন। মদিনার তিন দিকে খেজুরগাছের বাগান। বাকি থাকে একদিক।


সেদিকে পরিখা খননের কথা হজরত সালমান ফারসি (রাঃ) বলেন। পরিখা খনন ছিল পারস্য দেশের একটি যুদ্ধকৌশল। একটি ঘোড়া লাফ দিয়ে যতটুকু যেতে পারে, তার চেয়ে বেশি দূরত্বে গর্ত খনন করা হয়। তাই শুরু হলো পরিখা খনন। ১০ জন করে একটি গ্রুপ। প্রতিটি গ্রুপ দৈর্ঘ্য ১০ হাত, প্রস্থে ১০ হাত, গভীরতায় ১০ হাত পরিখা খনন করে। 


ছয় দিনে পরিখা খনন শেষ হয়। পরিখা খননকালে একটি বড় ও শক্ত পাথর সামনে পড়ে, যা ভাঙা অসম্ভব হয়ে পড়ে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিষয়টি জানানো হলে তিনি এসে আঘাত করলে তা ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। সম্মিলিত বাহিনী যখন মদিনায় এসে ‍উপনীত হয়, তখন সাহাবিদের খননকাজ শেষ। 


১০ হাজার সেনার বাহিনী ওহুদ পাহাড়ের পাশে তাঁবু ফেলে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৩ হাজার সাহাবি নিয়ে হাজির হলেন। দুই দল দুই দিকে, মাঝখানে খন্দক। কুরাইশ বাহিনী খন্দক দেখে হতভম্ব। তখন তারা মদিনা অবরোধ করে। শত্রুরা প্রায় এক মাস মদিনা অবরোধ করে রাখলো। এই অবরোধ এত কঠিন ছিল যে মুসলমানদের বহু বেলা খাবার না খেয়ে থাকতে হয়েছিল। অবরোধকারীরা কিছুতেই পরিখা পার হতে পারল না। 


 হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সৈন্যদের পরিখার বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করলেন। কাফেররা বাইরে থেকে পাথর ও তির ছুড়তে শুরু করলে এদিক থেকেও তার প্রত্যুত্তর দেওয়া হলো। এরই ভেতর বিক্ষিপ্তভাবে দু-একটি হামলাও চলতে লাগল। 


 অবরোধ যত দীর্ঘায়িত হলো, শত্রুদের উৎসাহও তত কমতে লাগল। ১০ হাজার লোকের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা মোটেই সহজ কাজ ছিল না। তার ওপর ছিল প্রচণ্ড শীত। এরই মধ্যে একদিন এমন প্রচণ্ড বেগে ঝড় আসেছিল যে কাফেরদের সব ছাউনি উড়ে গেল। তাদের সৈন্যসামন্ত ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। তাদের ওপর যেন আল্লাহর আজাব নেমে এল। 


আর বাস্তবিকই আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের জন্য রহমত এবং কাফেরদের জন্য আজাব হিসেবেই এ ঝড় পাঠিয়েছিলেন। কাফেররা এ পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারল না। অবস্থা বেগতিক দেখে ইহুদিরা আগেই সরে পড়েছিল। কুরাইশদেরও ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় রইল না। 


খন্দকের যুদ্ধে ৮ জন মুসলিম শহীদ হন। অন্যদিকে, শত্রুপক্ষে ৪ জন মারা যায়। অবরোধের সময়কাল কেউ বলেছেন ২৪ দিন, অন্য বর্ণনায় ১৫ দিন পাওয়া যায়। খন্দক যুদ্ধ সম্পর্কে আল্লাহপাক সুরা আহজাবে ৯ থেকে ২৭ পর্যন্ত ১৯টি আয়াত নাজিল করেন, যাতে এই যুদ্ধের বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। 



No comments

Powered by Blogger.