তাকলীদ - অনুসরণীয় এবং অনুকরণীয়

 

taqleed-following-imitating



ইসলামী শরী‘আতের মৌলিক দলীল চারটি। কিয়ামত পর্যন্ত আগত সব মানুষের সামগ্রিক জীবনের সর্বপ্রকার সমস্যার সমাধান এই চার দলীলের মধ্যেই নিহিত। তবে এ দলীল চতুষ্টয় থেকে সরাসরি সমস্যার সমাধান খুঁজে নেওয়া বা পাওয়া সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। 


এজন্য নবীযুগ থেকেই নিয়ম চলে আসছে যে, উম্মতের মধ্যে কুরআন, সুন্নাহ ও তা থেকে উৎসারিত ইলমে দ্বীন সম্পর্কে একটি দল পারদর্শিতা অর্জন করবে আর অন্যরা কুরআন সুন্নাহর বিধানাবলী জানার জন্য তাদের দারস্থ হবে এবং তাদের ব্যাখ্যা ও নির্দেশনা অনুসারে কুরআন সুন্নাহ অবগত হয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে।

এভাবে কুরআন ও সুন্নাহর পারদর্শীদের শরাণাপন্ন হয়ে তাদের নিকট থেকে শরয়ী বিধান এবং তাদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা, যোগ্যতা ও বিশ্বস্ততার প্রতি আস্থাশীল হয়ে তাদের বর্ণিত শরী‘আতের বিধান মেনে নেয়াকে ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় তাকলীদ বলা হয়।


হক্কানী উলামায়ে কেরামের অভিজ্ঞতা হলো, বর্তমানে দ্বীন থেকে বের হয়ে যাওয়ার সহজ পথ হলো, চার ইমামের তাকলীদ থেকে বের হয়ে যাওয়া অর্থাৎ চার ইমামের নেতৃত্বের বাহিরে যাওয়া হবে আত্মঘাতী এবং চরম ভুল সিদ্ধান্ত। তাই আজ খুবই সংক্ষিপ্ত করে তাকলীদের পরিচয় ও গুরুত্ব তুলে ধরার চেষ্টা করেছি আশা করি উপকৃত হবেন।

রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় সাহাবায়ে কেরাম অন্য সাহাবার তাকলীদ করেছেন। এরও অনেক দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। আবার এমনও দেখা যায় যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম  মৌখিকভাবে নির্দিষ্ট বা অনির্দিষ্ট করে কারো তাকলীদের স্বীকৃতি দিয়েছেন কিংবা কারও তাকলীদকে সমর্থন করেছেন।

কখনও কখনও তিনি গভর্ণর বানিয়ে একেক এলাকায় সাহাবায়ে কেরামকে পাঠিয়ে দিতেন এবং ওই এলাকার লোকদেরকে ওই সাহাবীকে তাকলীদ করে দ্বীনের উপর চলতে বলতেন। 


১. পরবর্তীদের জন্য সাহাবায়ে কেরামের তাকলীদ

হযরত আবূ সাইদ খুদরী রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার কয়েকজন সাহাবীকে জামা‘আতে বিলম্বে আসতে দেখে বললেন, তোমরা দ্রুত আসো এবং আমাকে দেখে দেখে অনুসরণ করো, তোমাদের পরবর্তী লেকেরা তোমাদের দেখে দেখে অনুসরণ করবে। (মুসলিম শরীফ ৪৩৮)


২. সাহাবা পরবর্তীদের জন্য সাহাবাদের তাকলীদ

হাদীসে এসেছে, আমার উম্মত তেহাত্তর ফিরকায় বিভক্ত হবে। তার মধ্যে একটি ছাড়া সকলেই জাহান্নামে যাবে। জিজ্ঞেস করা হল, ইয়া রাসূলুল্লাহ! সেই এক দলে কারা থাকবে। বললেন, ماانا عليه واصحابي অর্থাৎ যারা আমার ও আমার সাহাবীদের আদর্শের উপর থাকবে। জামে তিরমিযী ২৮৩২ এখানেও সাহাবীদের তাকলীদকে পরবর্তীদের জন্য নাজাতপ্রাপ্ত দলের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার মাপকাঠি নির্ধারণ করা হয়েছে।


৩. পরবর্তীদের জন্য নির্দিষ্ট সাহাবীদের তাকলীদের স্বীকৃতি

হযরত হুযাইফা রা. বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আমি জানি না কতদিন তোমাদের মাঝে (জীবিত) থাকব। আমার পরে তোমরা আবূ বকর ও উমর রা. এ দু‘ব্যক্তির ইকতিদা (অনুসরণ) করবে। জামে তিরমিযী ৩৬৬৩ হাদীসে ইকতিদা শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। ইকতিদা অর্থ দ্বীনি বিষয়ে কারও অনুসরণ করা। এর নামই তাকলীদ।

হযরত হুরাইস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. সম্পর্কে বলেছেন, আমি তোমাদের জন্য তাই পছন্দ করি যা আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. তোমাদের জন্য পছন্দ করে। মুস্তাদরাক ৫৩৯৪ এই হাদীসে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. এর পছন্দনীয় বিষয়গুলো সাহাবায়ে কেরামের জন্য অনুসরণীয় বলে ব্যক্ত করা হয়েছে। এটাই তাকলীদ।


৪. নবীজীর জীবদ্দশায় সাহাবীর তাকলীদের সমর্থন

হযরত সাহাল ইবনে মুআয রা. তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, জনৈক মহিলা রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার স্বামী জিহাদে শরীক হয়েছেন। তিনি থাকা অবস্থায় আমি তার নামায ও অন্যান্য সকল আমল অনুসরণ করতাম। 

এখন তার প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত আমাকে এমন কোনো আমল বাতলে দিন যা তার স্থলাভিষিক্ত হবে।এই হাদীসে মহিলার জন্য ইলমওয়ালা দ্বীনদার স্বামীর ইকতিদা ও অনুসরণকে সমর্থন করা হয়েছে। এরই নাম তাকলীদ।


৫. গভর্নর হিসেবে এবং দ্বীন শিক্ষায় তাকলীদ

নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত মুআয ইবনে জাবাল রা. ও হযরত আবূ মুসা আশআরী রা. কে ইয়ামানের ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের গভর্ণর করে প্রেরণ করেছিলেন। বুখারী শরীফ ৪৩৪১ বলা বাহুল্য, তারা সেখানকার জনগণকে দ্বীন শিক্ষা দিতেন। যা বুখারী শরীফের আরেকটি রেওয়ায়াত দ্বারা প্রমাণিত। (বুখারী শরীফ ১৩৯৫)

দেখা যাচ্ছে হযরত মুআয ইবনে জাবাল ও হযরত আবূ মুসা আশআরী রা. কে ইয়ামানবাসীর নিকট দ্বীনী বিষয়ে অনুসরণীয় হিসেবে পাঠানো হয়েছে। এটাই তাকলীদ। কারণ প্রত্যেক ব্যপারে ইয়ামানবাসীদের পক্ষে মদীনায় এসে নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে মাসআলা জেনে যাওয়া সুকঠিন ব্যাপার ছিল।


অনুরূপ বিভিন্ন কওমের প্রতিনিধিগণ মদীনায় এসে দ্বীনি বিষয়ে অবগত হয়ে ফিরে গিয়ে কওমকে তা শিক্ষা দিতেন আর কওমও নির্দ্বিধায় বিনা বাক্যব্যয়ে তাদের কথা মেনে নিতো। এর বহু দৃষ্টান্ত হাদীসের কিতাবে বিদ্যমান।

তাই নিরাপদে দ্বীনের অনুসরণ করতে হলে তাকলীদ বা নির্দিষ্ট মুজতাহিদ ও ইমামের তাকলীদ করা জরুরী। এটাকে হারাম বা শিরক বলা মারাত্মক পর্যায়ের পথ ভ্রষ্টতা। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের রক্ষা করুন।

No comments

Powered by Blogger.