ইয়ামামা'এর যুদ্ধ ।। কুসংস্কারের বিরুদ্ধে চুড়ান্ত বিজয় ।।

Battle of Yamama. Final victory against superstition.





হজরত আবু বকর (রা.)-এর খিলাফত লাভের পর বেশ কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়। ফলে রাষ্ট্রের কাঠামোর ওপর আঘাত আসে। বেশ কিছু আরব গোত্র বিদ্রোহ করে এবং কয়েকজন ব্যক্তি নবুওয়ত দাবি করে। তাদের মধ্যে মুসায়লিমা ছিল অন্যতম প্রধান। বিভিন্ন গোত্রের তরফ থেকে বক্তব্য আসে যে তারা শুধু মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি অনুগত ছিল এবং তার মৃত্যুর পর মিত্রতা শেষ হয়েছে। 


প্রাচীন আরবে এই ধরনের প্রথা প্রচলিত ছিল যার আওতায় গোত্রের নেতার মৃত্যুর পর মিত্রতা সমাপ্ত হতো। বিদ্রোহ গোত্রগুলো জাকাত দিতেও অস্বীকৃতি জানায়। আবু বকর (রা.) তাদের দাবি অস্বীকার করেন এবং বিদ্রোহ দমনে অগ্রসর হন। এসব ঘটনার ফলে রিদ্দার যুদ্ধের সূচনা হয়। মধ্য আরবে মুসায়লিমা ইয়ামামা থেকে ধর্মদ্রোহিতার নেতৃত্ব দেয়। বিদ্রোহের অন্য কেন্দ্রসমূহ বাহরাইন, ওমান, মাহরা, ইয়েমেনে অবস্থিত ছিল। 


 ✓ মুসলিম সেনাবাহিনীকে ১১টি দলে সংগঠিত করা হয় 
আবু বকর তার পরিকল্পনা প্রণয়ন করে মুসলিম সেনাবাহিনীকে ১১টি দলে গঠন করেন। সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাদলের নেতৃত্বে ছিলেন খালিদ বিন ওয়ালিদ। শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য তাদের ব্যবহার করা হয়। তুলনামূলক কম শক্তিশালীদের সঙ্গে লড়াইয়ে অন্য সেনাদলগুলোকে নিয়োজিত করা হয়। আবু বকর প্রথমে পশ্চিম ও মধ্য আরবের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা, এরপর মালিক ইবনে নুয়াইরাকে মোকাবিলা এবং চূড়ান্তভাবে সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ মুসায়লিমার মুখোমুখি হওয়ার পরিকল্পনা করেন। 


বেশ কিছু সফল ও ধারাবাহিক অভিযানের পর শেষ পর্যন্ত খালিদ বিন ওয়ালিদ মুসায়লিমাকে ইয়ামামার যুদ্ধে পরাজিত করতে সক্ষম হন। শেষ পর্যন্ত সব বিদ্রোহ দমন করা হলে আরব পুনরায় খিলাফতের আওতায় ঐক্যবদ্ধ হয়। ৬৩২ সালের জুলাই মাসে আবু বকর (রা.) মুহাম্মদ (সা.)-এর নিজ গোত্র বনু হাশিমের সদস্যদের নিয়ে একটি সেনাদল গঠন করেন। আলি ইবনে আবি তালিব, তালহা ইবনে উবাইদিল্লাহ ও জুবায়ের ইবনুল আওয়াম প্রত্যেকে সেনাদলের এক-তৃতীয়াংশের নেতৃত্ব লাভ করেন। 


তারা জু কিসার যুদ্ধে স্বঘোষিত নবী তুলায়হার সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে। তুলায়হা ও তার অনুসারীরা রিদ্দার যুদ্ধের সময় মদিনা আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিল। এই যুদ্ধে তুলায়হাকে পরাজিত করা হয়। আবু বকর (রা.) সর্বপ্রথম গ্রন্থাকারে কোরআন সংকলন করেন। ইতিপূর্বে কোরআনের বিভিন্ন অংশ বিচ্ছিন্নভাবে লিপিবদ্ধ ছিল। এ ছাড়াও হাফেজরা কোরআন মুখস্থ করে রাখতেন। ইয়ামামার যুদ্ধে অনেক হাফেজ শহীদ হলে উমর ইবনুল খাত্তাব গ্রন্থাকারে কোরআন সংকলনের জন্য আবেদন জানান। 


এই প্রথা মুহাম্মদ (সা.)-এর সময় ছিল না বলে প্রথমে আবু বকর (রা.) এতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু উমর (রা.) তাকে রাজি করাতে সক্ষম হন। এ জন্য জায়েদ ইবনে সাবিতকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এর সদস্যরা সবাই হাফেজ ছিলেন। তারা কোরআনের সব অংশ সংগ্রহ করে একক গ্রন্থ হিসেবে লিপিবদ্ধ করেন এবং হাফেজদের স্মৃতির সঙ্গে সেগুলো মিলিয়ে দেখা হয়।


 ✓ ইয়ামামা'এর যুদ্ধ যখন চূড়ান্ত  
দুই বাহিনীতে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। বনু হানিফার লোকেরা সাম্প্রদায়িক উন্মাদনার কারণে মিথ্যাবাদী নবীর জন্য অসম্ভব আগ্রহ উদ্দীপনার সাথে লড়াই করতে থাকে। মুসলমানগণ ইতিপূর্বে এমন মারাত্মক আক্রমনের শিকার হন নি। কয়েকজন প্রসিদ্ধ সাহাবী এক এক করে শহীদ হয়ে যান।


যুদ্ধের ময়দানের অবস্থা ছিল খুবই নাজুক। একবার মুসলমানরা বিজয়ী হতো আরেকবার কাফেররা। একবার মুসলমানদের পা উপড়ে যায়। মুসায়লামার বাহিনী তাদেরকে তাড়াতে তাড়াতে তাবু পর্যন্ত নিয়ে আসে। হযরত সাবেত বিন কায়েস রা. মুসলমানদের এই অবস্থা দেখে চিৎকার করে বললেন,


হে আল্লাহ আমি মুসলমানদের পক্ষ থেকে আপনার নিকট ক্ষমা চাচ্ছি। এরপর তিনি ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে তিনি যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে যান। একে একে হযরত সালেম, হযরত আবু হুফায়ফা, হযরত যায়েদ বিন খাত্তাব রা. প্রত্যেকেই শহীদ হয়ে যান।


হযরত খালিদ রা. মুসলিম বাহিনীকে নতুনভাবে বিন্যস্ত করেন। তারপর প্রবলবেগে আক্রমণ করেন। এতে শত্রুদের অবস্থান নড়বড়ে হয়ে যায়। মিথ্যা নবীর অনুসারীরা তখন দিগইবদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পলায়ন করতে থাকে। যুদ্ধের ময়দান থেকে অল্প কিছু দূরেই একটা বাগান ছিল।


 ✓ শহীদ মুসলমানদের ৭০০ জন ছিলেন কোরআনে হাফেজ 
"ইয়ামামার যুদ্ধ ৬৩২ সালের ডিসেম্বরে বর্তমান সৌদি আরবের ইয়ামামা নামক স্থানে মুসলিম ও স্বঘোষিত নবী মুসায়লিমার পক্ষের লোকদের মধ্যে সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধ রিদ্দার যুদ্ধের একটি অংশ ছিল। এই যুদ্ধে ১২০০ মুসলমান ও মুসায়লামার ২১ হাজার বিদ্রোহী সেনা নিহত হয়। 


শহীদ মুসলমানদের ৭০০ জন ছিলেন কোরআনে হাফেজ। কোন কোন মতে হাফেজের সংখ্যা ছিল ৮০০ জন। এই যুদ্ধকে আরব ধর্মত্যাগী বিদ্রোহীদের পতন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ইয়ামামার যুদ্ধ আবু বকরের(রাঃ) কুরআন সংকলনে ভূমিকা রাখে। মুহাম্মদ(সাঃ)এর জীবদ্দশায় কুরআনের বিভিন্ন অংশ সাহাবীদের কাছে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় লিখিত ছিল। 


ইয়ামামার যুদ্ধে ৭০০/৮০০ জন হাফিজ শহীদ হওয়ায় উমর (রাঃ) ভবিষ্যতে কোরআন সংরক্ষণের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেন এবং তাঁর পরামর্শে আবু বকর(রাঃ) সমগ্র কুরআন একটি খন্ডে সংকলনের নির্দেশ দেন।


 ✓ ইয়ামামা'এর যুদ্ধে চুড়ান্ত বিজয়  
তারা বাগানে পলায়ন করে মোর্চা তৈরি করে। হযরত বারা বিন মালিক রা. বারবার বলতে থাকেন, যেন তাকে বাগানে নিক্ষেপ করা হয়। যাতে তিনি সেখানে গিয়ে ভেতর থেকে দরজা খুলতে পারেন। তার ইচ্ছানুযায়ী তা করা হয়। এর মধ্যেই তার শরীরে আশির অধিক আঘাত লাগে।

মুসলমানরা বাগানে প্রবেশ করতে সক্ষম হন। এই স্থানে বিখ্যাত বদরী সাহাবী হযরত আবু দুজানা রা. শহীদ হয়ে যান। উম্মে উমারা ও তার ছেলে আব্দুল্লাহ বিন যায়েদ রা. ভেতরে প্রবেশ করেন। এক ব্যক্তি উম্মে উমারার হাত কেঁটে ফেলে।

তা সত্ত্বেও তিনি ময়দানে সাহসীকতার সাথে লড়াই করে যান। শেষ পর্যন্ত শত্রুরা বাগান থেকেও পলায়ন করতে থাকে। তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে এদিক ওদিক চলে  যায়। মুসায়লামাতুল কাজ্জাব ও তখন পলায়ন করতে থাকে।"



No comments

Powered by Blogger.