নবী করীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম তারিখ

date-birth-prophet-muhammad



Date of birth of Prophet Muhammad (PBUH).
আজ কাল অজ্ঞতা আর ভ্রান্ত মতবাদে ভরে গেছে আমাদের ইসলাম ধর্ম। যে যার মতো করে ধারণা পোষণ করছে, সঠিক ধারণা অনেকেই রাখছে না। আমরা শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উম্মত। আমাদের ঈমান আক্বিদায় ধারণ করে আছে সেই মহা মণিষী। আমাদেরকে তার প্রত্যেকটা বিষয়ে বিশদ জ্ঞান অর্জন করতে হবে। তাঁর জন্ম ও মৃত্যুর সঠিক তারিখ জানা উচিত। এই নিয়ে কোনো ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করা চলবেনা। হক্কানী নির্ভরযোগ্য ইতিহাসবিদদের উদ্ধৃতির আলোকে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম ও মৃত্যুর সঠিক তারিখ জেনে রাখা ঈমানী দায়িত্ব। 


∆ নবী করীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম তারিখ
নবী করীম হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম তারিখ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। তবে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম রবিউল আউয়াল মাসের কোনো এক সোমবার হয়েছে, এ ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য সকল ইতিহাসবিদ উলামায়ে কেরাম একমত। 
(আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২/২৮২)


জন্ম তারিখ সম্পর্কে বিভিন্ন ধরণের বর্ণনা পাওয়া যায়। নিম্নে বর্ণনাগুলোসহ সবগুলোর বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
১. রবিউল আউয়াল এর দুই তারিখ
২. রবিউল আউয়াল এর আট তারিখ
৩. রবিউল আউয়াল এর দশ তারিখ
৪. রবিউল আউয়াল এর বার তারিখ
৫. রবিউল আউয়াল এর সতের তারিখ
৬. রবিউল আউয়াল এর আট দিন বাকী থাকতে
৭. রমযান মাসের বার তারিখ। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২/২৮২)
এসব বর্ণনার মধ্য থেকে হাফেজ ইবনে কাছির রহ. ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ এর মধ্যে ‘দুই’ ‘আট’ ও ‘বার’ তারিখের কথা গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করেছেন। তাই আমরা শুধু এই তিনটি তারিখ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। ইনশাআল্লাহ।


আর মুহাম্মাদ বিন সাআদ রহ. ‘তবাকাতুল কুবরা’ নামক গ্রন্থে দুই ও দশ তারিখের মতকে গ্রহণ করেছেন। বার তারিখের মতটি প্রসিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও এ মতটির আলোচনা তাঁর কিতাবে স্থান পায়নি। দুই ও দশ তারিখের পক্ষে পেশ কৃত তার দলীলসমূহ সনদসহ উল্লেখ করা হলো,

✓ দুই তারিখের প্রমাণ 
‘ইবনে সাআদ তার উস্তাদ ওয়াকেদী এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, আবূ মা‘শার আল-মাদানী বলতেন, রবিউল আউয়াল মাসের দুই তারিখ সোমবার নবী করীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম জন্ম গ্রহণ করেছেন।’ (তবাকাতে ইবনে সাআদ ১/৪৭)
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হল, এ বর্ণনার রাবী ওয়াকেদী ও তার উস্তাদ আবূ মা‘শার উভয়েই ‘যয়ীফ’ অর্থাৎ দুর্বল। রিজাল শাস্ত্রের প্রসিদ্ধ ইমাম হাফেজ ইবনে হাজার আসকলানী রহ. ওয়াকেদী সম্পর্কে বলেনঃ متروك مع سعة علمه ‘প্রশস্ত জ্ঞানের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি পরিত্যাজ্য।’ তাকরীবুত তাহযীব পৃ. ৪৯৮) আর আবূ মা‘শার সম্পর্কে বলেছেনঃ ضعيف ‘সে যয়ীফ’ (তাকরীব পৃ. ৫৫৯) অতএব দুই তারিখের বর্ণনাটির বর্ণনাকারীরা মাতরুক ও যয়ীফ হওয়ায় এমতটি গ্রহণ করা গেল না।


✓ দশ তারিখের প্রমাণ 
দশ তারিখের দলীলের সূত্রেও ওয়াকেদী রয়েছেন। তাই দশ তারিখের দলীলটিও মাতরুক বিবেচিত হবে। (তবাকাতুল কুবরা ১/৪৭)

✓ আট তারিখের প্রমাণ 
জেনে রাখা উচিত যে, হস্তি বাহিনী যে বছর মক্কায় হামলা করেছিল সেবছরই রবিউল আউয়াল মাসে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম হয়। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সকল ইতিহাসবিদ উলামায়ে কেরাম একমত।


ইবনে কাছীর রহ. বলেন, ‘ইমামুল মাগাযী ইবনে ইসহাক বলেছেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম হস্তি বাহিনীর বছর হয়েছিল। এটিই জমহুরের নিকট প্রসিদ্ধ অভিমত। আর ইবরাহীম বিন মুনযির রহ. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম হস্তি বাহিনীর বছর হওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের উলামাদের নিকট কোনো সন্দেহ নেই।’ (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২/২৮৩)


অতএব, এতটুকু নিশ্চিতভাবে সাব্যস্ত হলো যে, হস্তি বাহিনীর মক্কায় আক্রমণের বছর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম হয়েছিল। এখন প্রশ্ন থেকে যায় যে, হস্তি বাহিনীর হামলার কয়দিন পর নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম হয়ে ছিল? হাফেজে হাদীস ইমাম সুহায়লী, ইমাম ইবনে কাছীর, ইমাম মাসঊদী রহ. এর নিকট বিশুদ্ধতম মত হল, হস্তি বাহিনী মক্কায় হামলার পঞ্চাশ দিন পর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম জন্ম গ্রহণ করেছেন। 


আবূ বকর মুহাম্মাদ বিন মূসা আল খাওয়ারেযেমী রহ. বলেন, হস্তি বাহিনী মক্কায় হামলা করে মুহাররম মাসের তের দিন বাকী থাকতে। তখন থেকে পঞ্চাশ দিন পর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম জন্ম গ্রহণ করলে জন্ম দিবস আটই রবিউল আউয়াল হয়। অতএব, সাব্যস্ত হলো যে, উল্লেখিত বড় বড় ইমামদের মতে নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম হয়েছিল আটই রবিউল আউয়াল। আরো বিস্তারিত জানতে দেখুনঃ (সুবুলুল হুদা ওয়ার রশাদ ফী সীরাতি খাইরিল ইবাদ ১/৩৩৫)


‘কারো কারো মতে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম রবিউল আউয়াল মাসের আট তারিখ জন্ম গ্রহণ করেন। শায়েখ কুতুবউদ্দিন (আবূ বকর মুহাম্মদ বিন আহমাদ) বলেছেন, এ মতটিই অধিকাংশ মুহাদ্দিসগণ গ্রহণ করেছেন এবং এ মতটিই হযরত ইবনে আব্বাস এবং জুবাইর বিন মুতইম রা. থেকে বর্ণিত আছে। 


ইতিহাস সম্পর্কে যার নূন্যতম ধারণা আছে সেও এমতটিই গ্রহণ করবে। হুমাইদি ও তার উস্তাদ ইবনে হাযম রহ.ও এ মতটি গ্রহণ করেছেন এবং কুযায়ী (আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মদ বিন সালাম) ‘উয়ূনুল মাআরেফ’ নামক গ্রন্থে আট তারিখে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম গ্রহণ সম্পর্কে মীকাতবাসীদের ঐক্যমতের কথা উল্লেখ করেছেন। এমতটিকেই হাফেজ যুহরী রহ. মুহাম্মাদ বিন জুবাইর বিন মুতইম থেকে বর্ণনা করেছেন। 


মুহাম্মাদ বিন জুবাইর নসবনামা ও আরবের ইতিহাস সম্পর্কে পণ্ডিত ছিলেন। মুহাম্মাদ তার পিতা জুবাইর বিন মুতইম থেকে এ বিষয়ে পাণ্ডিত্য গ্রহণ করেছেন।’ (আল মাওয়াহেবুল লাদুনিয়্যাহ ১/৮৫)
আল্লামা যারকাশী রহ.ও ‘শরহে যারকাশী আলাল মাওয়াহেব’ এর মধ্যে আট তারিখের মতকে প্রাধান্য দিয়েছেন। (শরহে যারকাশী আলাল মাওয়াহেব ১/২৪৬)


‘কেউ কেউ বলেছেন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম জন্ম গ্রহণ করেছেন রবিউল আউলায় এর আট তারিখ। এ মতটি হুমাইদী রহ. ইবনে হাযাম রহ. থেকে বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম মালেক রহ., উকাইল (ইবনে খালেদ) ও ইউনুস বিন ইয়াযীদ ইমাম যুহরী এর সূত্রে, আর ইমাম যুহরী মুহাম্মদ বিন জুবাইর বিন মুতইম এর সূত্রে আট তারিখের কথা বর্ণনা করেছেন। 


সুপ্রসিদ্ধ স্প্যানিশ আলেম ইবনে আব্দুল বার বলেছেন, ইতিহাসবেত্তাগণ আট তারিখের অভিমতকেই বিশুদ্ধ বলেছেন। তাছাড়া হাফেজে হাদীস মুহাম্মদ বিন মূসা আল খাওয়ারেযেমী নিশ্চিতভাবে আট তারিখকে সঠিক বলেছেন। আরেক হাফেজে হাদীস আবুল খাত্তাব উমর ইবনে হাসান ইবনে দিহইয়া স্বীয় গ্রন্থ ‘আত তানবীর ফী মাওলিদিল বাশীর ওয়ান নাযীর’ এর মধ্যে আট তারিখের অভিমতকেই প্রধান্য দিয়েছেন। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২/২৮২)


✓ বার তারিখের প্রমাণ 
হাফেজ ইবনে কাছীর রহ. বার তারিখের দলীল সম্পর্কে বলেনঃ ‘ইবনে ইসহাক রহ. বার তারিখের মতটি স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। আর ইবনে আবী শাইবা তার ‘মুসান্নাফ’ গ্রন্থে আফফান ইবনে মুসলিম এর সূত্রে সাঈদ ইবনে মীনা থেকে বর্ণনা করেন যে, জাবের (রাযি.)ও ইবনে আব্বাস (রাযি.) বলেছেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম হস্তি বাহিনীর মক্কায় আক্রমণের বছর রবিউল আউয়াল মাসের বার তারিখ সোমবার জন্ম গ্রহণ করেন। 


রবিউল আউয়াল মাসে তাকে নবুওয়াত দেয়া হয় এবং এ মাসে তাঁর মে‘রাজ হয় এবং এ মাসেই তিনি হিজরত করেন আর এ মাসেই তিনি ইন্তিকাল করেন। (হাফেজ ইবনে কাছীর বলেন,) জমহুরের নিকট এ মতটিই প্রসিদ্ধ। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২/২৮৩)


∆ লক্ষণীয় বিষয় 
১. বার তারিখের দলীল হিসেবে একটি হাদীস পেশ করা হল। এই হাদীসের রাবী আফফান বিন মুসলিম ও সাঈদ বিন মীনা উভয়ে নির্ভরযোগ্য। তবে আফফান বিন মুসলিম সাঈদ বিন মীনা থেকে সরাসরি হাদীস শুনতে পাননি। কারণ সাঈদ বিন মীনার ইন্তেকাল হয় ১১০ হিজরীর দিকে। 


আফফান বিন মুসলিমের জন্মই হয় ১৩৪ হিজরীর দিকে। (সূত্রঃ সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৯/২৫) এর দ্বারা বুঝা গেল যে, আফফান বিন মুসলিম এবং সাঈদ বিন মীনা উভয়ের মাঝে একজন রাবী আছে যার নাম এই সনদে উল্লেখ করা হয় নি। তাই এই হাদীসটি মুনকাতে হয়ে গেল। আর মুনকাতে হাদীস দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়।


২. হাফেজ ইবনে কাছীর রহ. এই মতটি বর্ণনা করার পর বলেছেন, ‘এই মতটি জমহুরের নিকট প্রসিদ্ধ’ লক্ষণীয় বিষয় হলো, এই মতটিকে তিনি প্রসিদ্ধ বলেছেন বটে কিন্তু বিশুদ্ধ বলেননি; বরং আট তারিখের মতকেই তিনি প্রকারান্তরে বিশুদ্ধ বলেছেন। জেনে রাখা উচিত যে, সব প্রসিদ্ধ বিষয়ই বিশুদ্ধ হয় না; বরং সমাজে অনেক এমন প্রসিদ্ধ বিষয় রয়েছে যা বিশুদ্ধ নয়। আমাদের মনে হয় এখানেও তেমনটিই ঘটেছে।


উপরিউক্ত আলোচনা দ্বারা একথা সাব্যস্ত হল যে, বড় বড় মুহাদ্দিস ইমাম ও ইতিহাসবিদগণের মতে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম রবিউল আউয়াল মাসের আট তারিখ সোমবার জন্ম গ্রহণ করেছেন। ঐতিহাসিক বিবেচনায় এটাই বিশুদ্ধ অভিমত। বার তারিখের দলীল সম্পর্কীয় হাদীস ‘মুনকাতে’। তাই বার তারিখের অভিমত প্রসিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও বিশুদ্ধ নয়।


No comments

Powered by Blogger.