তায়েফ'এর রক্তাক্ত দিনগুলো

bloody-days-of-taif-islamic-history




নবুওয়াতের এগারতম বছর। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচা আবু তালেব এবং স্ত্রী খাদিজা উভয়ে ইন্তেকাল করেছেন। স্বজন হারানোর এই প্রচণ্ড বেদনা উপেক্ষা করেই দাওয়াতের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। কিন্তু কাফেরদের অত্যাচার দিন দিন বেড়েই চলেছে। 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্যে মক্কায় অবস্থান করা দুর্বিষহ হয়ে পড়ছে। তিনি ভাবছেন, কিছুদিনের জন্যে হলেও দাওয়াতের ক্ষেত্র পরিবর্তন করা দরকার। এই ভাবনা থেকেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তায়েফে যাবেন বলে ঠিক করলেন। 

মক্কা থেকে একশ’ তের কিলোমিটার দূরে তায়েফ। স্বীয় পালকপুত্র যায়েদ ইবনে হারেসকে নিয়ে রওয়ানা হলেন তায়েফের পথে। তায়েফে সম্ভ্রান্ত বংশ হিসেবে পরিচিত ছিলো ‘বনু সাকীফ’। আবদে ইয়ালীল, মাসউদ ও হাবীব তিন ভাই ছিলো এই বংশের কর্ণধার। 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চিন্তা করলেন, নেতৃত্বের আসনধারীরা যদি ইসলাম গ্রহণ করে; অন্যরা এমনিতেই চলে আসবে। নবীজী তাই বনু সাকীফ গোত্রের এই তিন ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করলেন। ইসলামের দাওয়াত পেয়ে তাদের ব্যবহার বিগড়ে গেলো। 


একজন বললো, ‘আল্লাহ যদি তোমাকে নবী বানিয়েই থাকেন তবে কা’বার গেলাফ (মর্যাদা) ছিন্ন হতে চলেছে।’ অন্য ভাই বললো, ‘আল্লাহ কি নবী বানানোর জন্যে আর কাউকে খুঁজে পেলেন না। নবী কি পায়ে হেঁটে আসে। কোনো ধনী লোক অথবা সরদারকে নবী বানানো উচিত ছিলো।


আরেক ভাই বললো, ‘আমি তোমার সাথে কোনো কথাই বলব না।’ নবীজী বললেন, ঠিক আছে। তোমরা আমার কথা মানো বা না মানো, কাউকে ইসলাম কবুল করতে বাধা দিও না। আমি চেষ্টা করে দেখি, কাউকে বোঝাতে পারি কিনা। নবীজী আবার পথে নামলেন। 


তায়েফবাসীদের হেদায়াতের জন্যে ঘুরতে লাগলেন। কিন্ত তায়েফের সরদাররা বড় নীচুতার পরিচয় দিলো। দুষ্ট ছেলে আর বখাটের দলকে লেলিয়ে দিলো নবীজীর পেছনে। নবীজী হাঁটছেন। পেছনে ছুটছে দুষ্টের দল। চলছে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ আর গালাগাল। সেই সাথে চলছে ইট পাথর নিক্ষেপ। 


নবীজীকে পাগল বলছে তারা। পাথরের আঘাতে দেহ রক্তাক্ত। রক্তে জুতা আটকে গেছে পায়ের সাথে। কোথাও একটু বসার সুযোগও পাচ্ছেন না তিনি। বসতে চাইলেই হৈচৈ করে উঠিয়ে দিচ্ছে। যায়েদ ইবনে হারেস অনেক চেষ্টা করেও নবীজীকে পাথরের আঘাত থেকে রক্ষা করতে পারলেন না। 


তিনি নিজেও মারাত্মক আহত হলেন। অবশেষে অনেক কষ্টে তায়েফ থেকে বেরিয়ে এলেন। তায়েফ থেকে তিন মাইল দূরে একটি আঙ্গুরের বাগান। নবীজী আর যায়েদ বাগানের ছায়ায় বসে পড়লেন। একটু বিশ্রাম না নিলে পা আর চলছে না। বাগানের মালিক দুই ভাই। 


উতবা আর শাইবা। উভয়েই অমুসলিম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরীর দেখে তাদের দয়া হলো। গোলামকে আদেশ করলো, এদেরকে ঝুড়ি ভরে আঙ্গুর দাও। গোলামের নাম ছিলো আদ্দাস। সে আঙ্গুর এনে দিলো। রাসূলুল্লাহ তখন বিসমিল্লাহ বলে আঙ্গুর মুখে দিলেন। 


নবীজীর মুখে বিসমিল্লাহ শুনে আদ্দাস অবাক হয়ে বললো, এখানকার লোকেরা তো এই বাক্য বলে না! নবীজী প্রশ্ন করলেন, তুমি কোন এলাকার? তোমার ধর্ম কী? সে বললো, আমি খৃস্টান। নিনওয়ার অধিবাসী। রাসূলুল্লাহ সা. তার উত্তর শুনে বললেন, তুমি তো নেককার মানুষ ইউনুস ইবনে মাত্তার এলাকার লোক।


একথা শুনে আদ্দাস আরো বেশি অবাক হয়ে গেলো। বললো, আপনি তাকে কীভাবে চেনেন? নবীজী বললেন, তিনি আমার ভাই। তিনিও নবী ছিলেন। আমিও নবী। একথার পর আদ্দাস নবীজীর হাত, পা ও কপালে চুমু খেতে লাগলো। বাগানে বসেই রাসূলুল্লাহ সা. দু’হাত উপরে তুললেন। 


না, তায়েফবাসীর জন্যে কোনো বদ দু‘আ করলেন না। বরং নিজের দুর্বলতা ও উপায়হীনতার কথা বলে আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণ করলেন। দীন প্রচারের জন্যে আল্লাহর কাছে শক্তি কামনা করলেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দু‘আর পর জিবরাঈল আ. এসে উপস্থিত হলেন।
 

সাথে তায়েফের দু’ পাহাড়ের দায়িত্বশীল ফেরেশতা। তারা বললো, হুযুর আপনি অনুমতি দিন। দুই পাহাড়কে আমরা একত্র করে দিই। নিস্পেষিত করে দিই দুই পাহাড়ের মাঝে অবস্থানকারী তায়েফবাসীকে। নবীজীর অন্তর কেঁপে উঠলো। আন্দোলিত হলো মমতার সাগর। 


বললেন, না, না। এমন করার কোনো দরকার নেই। ওরা ইসলাম গ্রহণ করেনি। কিন্তু হতে পারে ওদের আগামী প্রজন্ম মুসলমান হবে।‌ উম্মতের প্রতি এতটাই দরদী দিল্ ছিলেন নবীজী। এক বর্ণনা অনুযায়ী দীনের জন্যে সকল নবীর চেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছেন মোহাম্মদ (সা.)


আরেকবার নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমার জীবনে সবচেয়ে মারাত্মক নির্যাতিত হয়েছি তায়েফে। কিন্তু তায়েফের মানুষের জন্য‌ই আল্লাহর রাসূল সবচেয়ে বেশি দোয়া করেছেন। আল্লাহর রাসূল সব সময় উম্মতের হেদায়েতের দোয়া করতেন। 


No comments

Powered by Blogger.