হুনাইন'এর যুদ্ধ || আরবের শেষ যুদ্ধ
Battle of Hunain || The last Arab war
মক্কা বিজয় সম্পন্ন হলেও তখনো আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে কিছু গোত্র ছিল, যারা ইসলামের কর্তৃত্ব মন থেকে মেনে নিত পারছিল না। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর নেতৃত্বের প্রতি হিংসার বশবর্তী হয়ে এসব গোত্র গুলো (মক্কার আশেপাশেই থাকতো) বিদ্রোহ করার পরিকল্পনা করে।
আরো একটা বিষয় তাঁরা খুব গভীর ভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিল যে, যেহেতু মক্কা বিজয় হয়েই গেছে, সেহেতু মুসলমানদের পরবর্তী আঘাত তাদের উপরই এসে পড়বে। এই বিদ্রোহের কাজে সবচেয়ে উৎসাহী ছিল হুনাইনের হাওয়াজিন এবং সাকিফ নামের দুটি গোত্র। এই দুই গোত্রের সাথেই মুহাম্মদ (সাঃ) এর নেতৃত্বে মুসলমানরা আরবের শেষ যুদ্ধে মুখোমুখি হয়।
পবিত্র কোরআন শরীফে এসেছে, হুনাইনের দিনগুলোর কথা মনে করো। যখন তোমরা নিজেদের সংখ্যাধিক্যতে সন্তুষ্ট ছিলে; কিন্তু তাতে তোমাদের কোনো কাজ হয়নি। বরং জমিন বিস্তীর্ণ থাকা সত্ত্বেও তা তোমাদের জন্যে সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছিলো এবং তোমরা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে পালিয়েছিলে। অতঃপর আল্লাহ তাঁর রাসূল এবং মুসলমানদের ওপর নিজের পক্ষ থেকে সান্ত্বনা ও প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তোমরা দেখতে পাওনি এমন সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করে কাফিরদের শাস্তি দিলেন। কাফিরদের জন্যে এমনি শাস্তিই নির্ধারিত। (সূরা তাওবাঃ ২৫,২৬)
✓ হুনাইন'এর যুদ্ধের প্রেক্ষাপট
মক্কা বিজয়ের পর আরবের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ দলে দলে এসে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। অনেক পৌত্তলিক যারা প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে মহানবী (স) এর বিরোধিতা করতো, তারাও মুহাম্মদ (স) কে এক নজর দেখতে উঁকিঝুকি দিতে থাকে। ফলাফল হিসেবে দ্রুতগতিতে ইসলামের প্রসার হতে থাকে।
আর তা প্রত্যক্ষ করে তায়েফের দুই প্রভাবশালী যুদ্ধবাজ গোত্র হাওয়াজিন এবং সাকিফ গোপনে গোপনে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। তারা বুঝতে পেরেছিল এটাই হয়তো শেষ সুযোগ। এবার মুসলমানদের পরাজিত করতে না পারলে তাদের অস্তিত্ব চিরতরে মুছে যাবে। সেজন্য তারা আরবের অন্যান্য অঞ্চলের ছোটখাটো পৌত্তলিক গোত্রদের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে প্রস্তুতি নিতে থাকে। মালিক ইবনে আওফ নাযারী নামের গোত্র প্রধানকে বাদশাহ মনোনীত করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়।
✓ চুড়ান্ত হুনাইন'এর যুদ্ধ
হাওয়াজিন ও সাকিফ গোত্রের নেতৃত্বে পৌত্তলিক গোত্রদের সম্মিলিত শক্তির যুদ্ধ প্রস্তুতির সংবাদ অচিরেই অবগত হয় মুসলিমরা। এদেরকে মোকাবেলা করতে মহানবী (স) তার সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করেন। মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে মুসলিমদের সামরিক শক্তিও পৌছে গেছে অনন্য এক উচ্চতায়। তাই স্বাভাবিকভাবেই একটি শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে মুসলিমরা ৬৩০ সালের এই ঐতিহাসিক যুদ্ধে পৌত্তলিক গোত্রদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যথাযথ রণসাজে প্রস্তুত হয়।
অষ্টম হিজরির শাওয়াল মাসের ১০ তারিখে প্রায় বারো হাজার সৈন্য নিয়ে প্রবল আত্মবিশ্বাসে তায়েফ ও মক্কা শহরের মধ্যবর্তী হুনাইন নামক জায়গার উপকন্ঠে মুসলিমরা তাদের শিবির স্থাপন করে। এদিকে হাওয়াজিন ও সাকিফ গোত্রের সম্মিলিত এ জোটের সদস্যরা পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান নিতে থাকে। নিজেদের পরিচিত অঞ্চল বলে হুনাইনের পাহাড়ি এলাকার সুফল লাভ করে পৌত্তলিকরা।
তাদের তীরন্দাজ বাহিনী পাহাড়ের বিভিন্ন প্রান্তে অস্ত্র তাঁক করে মুসলমানদের উপর আক্রমণের সকল প্রস্তুতি নিতে থাকে। এদিকে মক্কার মুসলিম সৈন্যরা নিজেদের শক্তিমত্তা নিয়ে দম্ভোক্তি করতে থাকে। কেউ কেউ অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের তোপে আগেভাগেই নিজেদের বিজয়ী ঘোষণা করে পৌত্তলিকদের তুচ্ছাতিতুচ্ছ করতে থাকে। এমন সময় আকস্মিকভাবে হুনাইনের পাহাড় থেকে বৃষ্টির মত তীরের আঘাত আসতে থাকে।
অপ্রস্তুত মুসলমানরা বুঝতে পারে তারা আক্রান্ত হয়েছে। ওদিকে প্রতিপক্ষের অবস্থান স্পষ্ট করতে না পেরে ক্রমাগত তীরের আঘাতে জর্জরিত মুসলিম সৈন্যদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। অবস্থা বেগতিক দেখে বেশিরভাগ সৈন্যই ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যেতে থাকে। এদিকে যুদ্ধ পরিস্থিতি সম্পূর্ণ প্রতিকূলে চলে গেলে মহানবী (স) ক্রমাগত সৈন্যদের না পালানোর জন্য আহ্বান করেন।
তিনি জোরে জোরে যুদ্ধ ময়দানে কবিতা আবৃত্তি করতে থাকেন। শীর্ষস্থানীয় কিছু সাহাবী তখনো বীর বিক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। মহানবী (স) এর প্রেরণাদায়ক বক্তব্য আর আল্লাহ তায়ালার সরাসরি অনুগ্রহে মুসলমান যোদ্ধাগণ আবার যুদ্ধের ময়দানে ফিরে আসে। মুহূর্তের ভেতরেই যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। মুসলমানরা বীর বিক্রমে শত্রুদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে।
এবার পৌত্তলিকরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পালাতে থাকে। যুদ্ধ শেষে দেখা যায় শত্রুপক্ষের ৭০ জন সৈন্য নিহত ও সহস্রাধিক সৈন্য বন্দি হয়েছে মুসলিম বাহিনীর কাছে। বাকি পৌত্তলিক সৈন্যরা পালিয়ে গিয়ে তায়েফের অভ্যন্তরে একটি শক্তিশালী দুর্গে অবস্থান করে। মুসলিমরা তাদের পশ্চাদপসরণ করে প্রায় বিশ দিন অবরুদ্ধ করে রাখে। বিশ দিন পর এই অবরোধ তুলে নেয়া হয় এবং মুসলমানরা চূড়ান্তভাবে বিজয়ীর বেশে ফের মক্কায় আগমন করে।
✓ হুনাইন 'এর যুদ্ধের তাৎপর্য
ইসলামের ইতিহাসে হুনাইনের যুদ্ধ ছিল ঠিক ওহুদের যুদ্ধের মতই একটি তাৎপর্যপূর্ণ যুদ্ধ। আত্ম অহংকার যে কতটুকু বিপদ ডেকে আনতে পারে তা স্পষ্ট হয়ে উঠে তাদের কাছে। পবিত্র কোরআনে এ যুদ্ধকে আল্লাহর পক্ষ থেকে ঐশ্বরিক সাহায্য বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এ যুদ্ধের পর ইসলাম প্রচার প্রসারে কার্যত আর কোন বাধা রইল না।
আরব ছাপিয়ে ইসলাম তখন পৌছে যায় প্রাচ্যের পথেঘাটে। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত খুব কম সংখ্যক যুদ্ধের মধ্যে ঐতিহাসিক হুনাইনের যুদ্ধ একটি। মুসলমানদের নিজেদের সম্পর্কে দাম্ভিকতা যে কতটুকু বিপদ ডেকে আনতে পারে এই যুদ্ধ ছিল তার একটি উৎকৃষ্ট প্রমাণ। এজন্য আল্লাহ তায়ালা নিজে কোরআনে বলেছেন তিনি এ যুদ্ধে মুসলমানদের উপর প্রশান্তি বর্ষণ করেছেন।
No comments